আরবি বিশ্ববিদ্যালয় নোট, ইমাম তিরমিযী জীবনী, ইসলামি ইতিহাস নোট

ইমাম তিরমিযী (র.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী, শুদ্ধাশুদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর স্থান এবং তাঁর রচনাবলি ও তাঁর কিতাবের অনুসৃত পদ্ধতি বর্ণনা কর।

: اكتب نبذةً مِن حَيَاةِ الْإِمَامِ التَّرْمِذِي مَعَ بَيَانِ مُنْزِلَيْهِ فِي الْجَرْجِ. ِيلِصْقَّالتِب ِهِابَتِك َجَهْنَمَو ِهِاتَفَلْوُمَو ِيلِدْعَّالتَو■

✅ প্রশ্ন–১: ইমাম তিরমিযী (র.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী, শুদ্ধাশুদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর স্থান এবং তাঁর রচনাবলি ও তাঁর কিতাবের অনুসৃত পদ্ধতি বর্ণনা কর।

উপস্থাপনা:
যেসব মহাপুরুষ তাঁদের জীবনের পরিশ্রম, ইলম, তাকওয়া ও নিষ্ঠার মাধ্যমে নবীজী (স.)-এর হাদীসকে সংরক্ষণ, যাচাই ও প্রচারের মহান কাজ করেছেন—ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত্-তিরমিযী (র.) তাঁদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু হাদীস সংগ্রাহকই নন; বরং ছিলেন হাদীস বিশ্লেষণ, রাবী-সমালোচনা এবং ফিকহী ইমামদের মতামত উপস্থাপনে অতুলনীয় প্রতিভাধর একজন আলেম। নিচে তাঁর জীবন, স্থান, রচনাবলি ও সংকলন-পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।

১. ইমাম তিরমিযী (র.)–এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

নাম ও পরিচয়
তাঁর নাম মুহাম্মদ, কুনিয়াত আবু ঈসা, আর জন্মস্থানের nisbat অনুযায়ী তিনি আত্-তিরমিযী নামে পরিচিত হন। বংশপরিচয়ে তিনি সুলামী গোত্রভুক্ত ছিলেন।

বংশপরিচয়
সম্পূর্ণ নাম:
আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সুরাহ ইবনে মুসা ইবনে দাহহাক আস্-সুলামী আল-বুগী আত্-তিরমিযী।

জন্ম ও পরিবার
তিনি হিজরী ২০৯ সনে, বলখ অঞ্চলের তিরমিযের নিকটবর্তী বুগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার পূর্বে মারের অধিবাসী ছিল, পরবর্তীতে তিরমিয এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

শিক্ষাজীবন
* প্রাথমিক শিক্ষা নিজ এলাকায় গ্রহণ করেন।
* তরুণ বয়সেই হাদীস ও ফিকহ শিক্ষায় গভীর আগ্রহ জন্মে।
* উচ্চতর ইলমের জন্য তিনি সে সময়ের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের শরণাপন্ন হন।
* ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদসহ বহু ইমাম থেকে শিক্ষা লাভ করেন।
* তাঁর প্রতিভা ছিল বিস্ময়কর — একবার শোনা মাত্র হাদীস মুখস্থ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর স্বভাবজাত।

ইলমের সফর
বিভিন্ন শহরে হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি দীর্ঘ সফর করেছেন—
বসরা, কুফা, ওয়াসিত, রায়, খোরাসান ও হিজায**—এ সকল স্থানের বড় বড় মুহাদ্দিসদের নিকট থেকে রেওয়ায়াত সংগ্রহ করেছেন।

আধ্যাত্মিক চরিত্র
তাকওয়া, ইবাদত ও আল্লাহভীতিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চস্তরের মানুষ। দীর্ঘ সময় কাঁদতে কাঁদতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়—এমন বক্তব্য জীবনীকারদের বর্ণনায় পাওয়া যায়।

ইন্তেকাল
হিজরী ২৭৯ সনের ১৩ রজব, সোমবার, নিজ জন্মস্থান বুগ গ্রামেই তাঁর ইন্তেকাল হয়। মৃত্যুকালে বয়স ছিল প্রায় ৭০ বছর।

২. শুদ্ধাশুদ্ধির (জারহ ও তা’দীল) ক্ষেত্রে তাঁর স্থান
ইমাম তিরমিযী (র.) হাদীস গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ, রাবীর যোগ্যতা যাচাই (জারহ–তা’দীল) এবং হাদীসের ধরণ বিশ্লেষণে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ।

তাঁর জারহ-তা’দীল বিশেষত্ব
* তিনি হাদীস শেষে সহীহ, হাসান, গরীব ইত্যাদি পরিভাষা উল্লেখ করতেন—যা তাঁর গভীর বিশ্লেষণী দক্ষতার প্রমাণ।
* কোন রাবী গ্রহনযোগ্য, কার বর্ণনায় ত্রুটি আছে – এসব বিষয়ে তাঁর মন্তব্যসমূহ আজও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
* তাঁর কিতাবে স্বয়ং-বর্ণিত বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, তিনি হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞানে একজন প্রতিষ্ঠিত ইমাম।

৩. ইমাম তিরমিযী (র.)–এর রচনাবলি
ইমাম তিরমিযী অসংখ্য বহুমূল্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে অধিক পরিচিত—
১. আল-জামে‘ আত্-তিরমিযী
তার শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক খ্যাতিমান গ্রন্থ।
হাদীস, ফিকহ, ইমামদের মতামত, রাবীগণের পরিচয় — সবকিছু সমন্বিত একটি সমৃদ্ধ সংকলন।
২. আশ-শামায়েল মুহাম্মাদিয়্যাহ
নবীজী (স.)-এর চরিত্র, আচরণ, আচার-ব্যবহার, দৈনন্দিন জীবন—এসব বিষয়ে অনন্য গ্রন্থ।
মোট ৪০০ হাদীস, ৫৬টি অধ্যায়।
৩.আল-ইলালুস্-সুগরা ও আল-ইলালুল-কুবরা
হাদীসের গোপন ত্রুটি নির্ণয়ে রচিত।
৪.আল-জারহু ওয়া ত্-তা’দীল সংক্রান্ত আলোচনা** (কিছু কিতাবে সংকলিত)
৫. আল-ফরায়েদ, আল-তاريخ, আল-জুহদ
আরও কয়েকটি কিতাব তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধিত বলে গবেষকদের মত রয়েছে।

৪. তাঁর কিতাবের অনুসৃত পদ্ধতি (মানহাজ)**
১. বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস
তিনি তার জামে গ্রন্থকে ৫১টি কিতাবে ভাগ করেছেন —
কিতাবুত-ত্বাহারাহ দিয়ে শুরু এবং কিতাবুল-মানাকিব দিয়ে সমাপ্ত।
২. প্রতিটি কিতাবকে বিভিন্ন বাব বা উপশিরোনামে বিভক্ত করেছেন।
৩. হাদীস নির্বাচন
সহীহ, হাসান, গরীব — প্রতিটি হাদীসের মান উল্লেখ করেছেন।
প্রমাণসহ ইমামদের মতামত উপস্থাপন করেছেন।
৪.রাবীর পরিচয় ও মূল্যায়ন
রাবীর শক্তি–দুর্বলতা, গ্রহণযোগ্যতা–অগ্রহণযোগ্যতা — যেখানেই প্রয়োজন সেখানে উল্লেখ করেছেন।
৫. ফিকহী বিধান ব্যাখ্যা
ফকীহদের মতপার্থক্য তুলে ধরে প্রতিটির দলিলও উল্লেখ করেছেন—যা তাঁর কিতাবকে ফিকহ শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান করেছে।
৬. বর্ণনার শৃঙ্খলা
হাদীসগুলোকে তিনি একটি প্রশংসনীয় ধারাবাহিকতায় সাজিয়েছেন যাতে পাঠক একটি বিষয়ের গভীরতা সহজে উপলব্ধি করতে পারে।

উপসংহার
ইমাম তিরমিযী (র.) হাদীসশাস্ত্রের ইতিহাসে অমর ব্যক্তিত্ব। তাঁর ‘জামে আত্-তিরমিযী’ শুধু একটি হাদীস গ্রন্থ নয়; বরং হাদীস বিজ্ঞান, ফিকহী মতামত, রাবী-সমালোচনা – সবকিছুর সমন্বিত এক অনন্য উপহার। নবীজী (স.)-এর বাণী সংরক্ষণের এই মহান প্রচেষ্টায় তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।